দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা। বিজ্ঞান, ইংরেজি ও বাংলা মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় হুড়হুড় করে বাড়ছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। ফলে, একদিকে যেমন নিম্নআয়ের ব্যাপক জনগোষ্ঠী শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে, অন্যদিকে বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি ও কারিগরি জ্ঞানহীন একটি প্রজন্মের সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষার মূলস্রোতের বাহিরে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার প্রসারে দেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটার আশু সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। একাধিক স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ মাদ্রাসার বাঁধভাঙা প্রসার নিয়ে সতর্কবার্তা দিলেও সরকার কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে।

বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা কাঠামোতে পূর্বে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক-মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেতেন। পরবর্তী আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আচমকা প্রচলিত শিক্ষার বাহিরে ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার পেতে শুরু করে। তখন কয়েক জেলায় মিলে একটি কিংবা দুটি মাদ্রাসা দেখা যেতো। সারাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মাদ্রাসায় পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা হতো মাদ্রাসার আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন বাসিন্দার বাড়িতে। কিন্তু বিগত পনের বছরে মাদ্রাসার প্রসার এতোটাই বেড়েছে এখন প্রতিটি পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতে মাদ্রাসার দেখা পাওয়া যায়। শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে আবাসিক ভবনগুলোতেও দু-একটি করে মাদ্রাসা পরিচালনা করা হচ্ছে। শতাব্দির শুরুতে মানুষ মাদ্রাসায় পড়তে যেতো, ১৫ বছর পর মাদ্রাসা মানুষের ঘরে এসে পড়েছে। কিভাবে এমনটি হলো?

বাংলাদেশের মানুষ তার নিজস্ব বাঙালী সংস্কৃতিকে বর্জন করে আরব্য সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ায় ধর্মান্ধতা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ইসলামিক অনুশাসনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। এসময় হুজুর ও মাওলানারা তাদের ওয়াজের মাধ্যমে মাদ্রাসায় ইসলাম ও কোরআন শিক্ষাগ্রহণে সওয়াব ও পাপমুক্তির ব্যাপক প্রচারণা করতে থাকে। ফলে পিতা-মাতা ও পরিবারের ধর্মান্ধতার বলি হয়ে শিশুরা বন্দী হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষার কারাগারে।

একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশ উন্নয়ন সাধন করে। কিন্তু বিশেষ শ্রেণি ও শহরকেন্দ্রিক এই উন্নয়ন দেশে ধনী-দরিদ্রের মাঝে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। ফলে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী সহজলভ্য ধর্মভিত্তিক শিক্ষায় ঝুঁকে পড়ে। মাদ্রাসাগুলোতে কম খরচে বা বিনামূল্যে ইসলামী পড়াশুনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কিভাবে মাদ্রাসাগুলো আয় ও ব্যয় মেটাতো সেটি নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করছি।

আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষায় ধাবিত করার দায়িত্ব এড়িয়ে সরকার ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। সরকারি অর্থায়নে আলিয়া মাদ্রাসা পরিচালনার মধ্যদিয়ে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা আরো প্রসারিত হয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসার বাহিরেও সরকার অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোকে অর্থ, জমি ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করেছে। সরকারের আশকারা পেয়ে মাদ্রাসাগুলোর শাখা প্রশাখা সারাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।

শিক্ষার্থীদের কম খরচ কিংবা বিনা খরচে পড়ানো হলেও মূলত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রীকভাবে মাদ্রাসাগুলোতে অর্থায়ন করা হয়। মানুষের কাছ থেকে ঘরে ঘরে গিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দিয়ে দান সহায়তা সংগ্রহ করা হয়। নগদ টাকার বাহিরেও স্থানীয় প্রকৃতিক ও কৃষিজ বিভিন্ন পণ্য মাদ্রাসাপড়ুয়া শিশুদের দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া ধর্মান্ধ মানুষ বিভিন্ন রোগমুক্তি আশায় ও মানতের নামে মাদ্রাসাগুলো দান করেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই মাদ্রাসাগুলো ব্যাপক ধন-সম্পদের মালিক বনে গেছে।

দেশের সীমা ছাড়িয়ে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশীদের আয়ের উপর ভাগ বসায় মাদ্রাসাগুলো। মাদ্রাসার আশেপাশের এলাকাগুলোর যারা বিদেশে থাকেন তাদের সাথে মাদ্রাসা প্রতিনিধি কমিশন এজেন্ট হয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মাদ্রাসার জন্য টাকা আদায় করেন। আদায়কৃত অর্থের একটি অংশ মাদ্রাসা প্রতিনিধি কমিশন হিসেবে পেয়ে থাকেন। এছাড়া ইসলাম ভিত্তিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশে মাদ্রাসাগুলোকে অর্থসহায়তা করে থাকেন। ফলে মাদ্রাসাগুলোতে আরো বেশি অর্থের জোগান হতে থাকে। মাদ্রাসা স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পর মহামারি আকারে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বিগত পনের বছরে দেশের বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের আগ্রহের বেশ কমতি ছিলো। দেশের জনসংখ্যা ও শিক্ষার্থী বৃদ্ধির তুলনায় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক কম। ফলে ইসলাম ভিত্তিক মাদ্রাসা বিকল্প শিক্ষা হয়ে ওঠেছে। সরকার পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত মূলধারার শিক্ষাকার্যক্রম পৌঁছাতে পারেনি। মাদ্রাসার ব্যাপক প্রসারে দেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটলে এর প্রধান দায় সরকারকেই নিতে হবে।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন সরকার দেশের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত না করে শিক্ষাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। দেশে সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিপরীতে বেসরকারি উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে প্রচুর স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেসরকারি এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করছে। ফলে, নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী মূলধারার শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষায় ঝুঁকে পড়ে।

মানুষের মাঝে ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে পড়ার পর সমাজে একধরনের ধর্মব্যবসার প্রচলন ঘটেছে। ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে আরো বেশি মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন সমাজের চোখে ভালো মানুষের তকমা অর্জনের জন্য। সমাজের ধর্নাঢ্য ব্যক্তিরা নিজেদের অর্থায়নে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলেও নিজেদের পরিবারের কোনো সদস্যকে মাদ্রাসায় পড়ানোর বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাপ মোচন ও মৃত্যুপরবর্তি সুখ-শান্তির আশায় নিজের অর্থায়নে মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তির জনপ্রিয়তা বেশ প্রভাব বিস্তার করে। অন্যদিকে, ধর্মান্ধ সমাজে ধর্মের সেবা করা দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের অব্যর্থ হাতিয়ার হয়ে ওঠেছে। ক্ষমতালোভীরা দেশ ও সমাজে নিজের ক্ষমতা বিস্তারের জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে, বিনা প্রয়োজনেই অলি-গলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একাধিক মসজিদ-মাদ্রাসা।

স্বাধীনতার এতোবছর পরও বাংলাদেশে এখনো মানুষের মৌলিক নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে- এখানে প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ ও এতিম শিশুরা সমাজে ব্যাপকহারে প্রতিবন্ধকতা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাদ্রাসাগুলো এতিমখানা নামক প্রকল্প চালু করে এতিম শিশুদের ধর্মভিত্তিক শিক্ষায় সম্পৃক্ত করেছে। মাদ্রাসাগুলো এতিম শিশুদের থাকা-খাওয়া ও শিক্ষার ব্যবস্থা করার প্রকল্প দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহ করেছে। বেশিরভাগ এতিমখানাগুলোতে গেলে দেখা যায় শিশুরা খাদ্যকষ্টে কঙ্কালসারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে এতিমখানার পরিচালকরা ব্যাপক অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছেন।

মাদ্রাসায় কি পড়ানো হয়?

বাংলাদেশে মূলধারার পড়াশোনায় গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি ভাষা, ইতিহাস, পরিবেশ, বিজ্ঞান, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। যেখানে শিক্ষিত হয়ে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা মানবিক মূলবোধের শিক্ষাও অর্জন করে। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শুধুমাত্র ইসলাম কেন্দ্রিক পড়াশুনা করানো হয়, যেখানে বিজ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষা থাকে নিষিদ্ধ। ইসলাম তথা আরব্য সমাজের বাহিরে পুরো পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব মাদ্রাসা শিক্ষায় অনুপস্থিত। ইসলামের বিধান, নবী-রাসূলদের জীবন, যুদ্ধ ও জিহাদই মাদ্রাসা শিক্ষার মূল উপাদান। মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ভিন্নধর্মের প্রতি ঘৃণা ও প্রতিহিংসা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এবং ইসলামের প্রসারে জিহাদের জন্য যাবতীয় শিক্ষা ও অনুশীলনে পারদর্শী হয়ে ওঠে।

পরিণাম

আপতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে- নানান বিতর্ক থাকলেও মাদ্রাসা শিক্ষার কিছু ভালো দিকও রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কি থাকা উচিৎ নাকি মাদ্রাসা শিক্ষা নিষিদ্ধ করা উচিৎ? এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিচের আলোচনাটি পড়ে নেয়া যাক-

আধুনিক শিক্ষাবিমূখ প্রজন্ম- মাদ্রাসায় শুধুমাত্র ইসলামকেন্দ্রিক পড়াশুনার ফলে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষা, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ইংরেজি ও কারিগরি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে- মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা শেষ করে শিক্ষার্থীরা ভালো কোনো পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারছে না। এতেকরে দেশে একটি বৃহৎ বেকার জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। এই বেকার জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ নতুন করে আরো মাদ্রাসা কিংবা আরবি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। ফলে দিনকে দিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

দরিদ্র পরিবারের এবং এতিম শিশুদের মাদ্রাসায় দিনের পর দিন বন্দী করে রাখা হয়। শিশুরা খেলাধুলা এবং মুক্তবাতাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসকল শিশুদের মাদ্রাসার শিক্ষক এবং পরিচালকরা তাদের বাসার যাবতীয় কাজে নিয়োজিত করেন। এছাড়া মাদ্রাসায় শিশুদের বেত ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শাস্তি দেয়া হয়। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মাদ্রাসা শিশুদের বলাৎকার (ধর্ষণ) এর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকার কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

মাদ্রাসাগুলোতে ভিন্ন ধর্ম কিংবা ভিন্ন মতের প্রতি প্রতিহিংসা ও আক্রমণাত্মক শিক্ষা দেয়ার ফলে বেকার এই জনগোষ্ঠী দেশের শান্ত পরিস্থিতিকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। যাদের মূল উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাতিল করে ইসলামি শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে ইসলামি মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশ ঘটিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো। যেই সমাবেশ থেকে তারা ঘোষণা করে বিজ্ঞান চর্চা নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নারীদের অধিকার বাতিল করতে হবে। সমাবেশে তারা নারী সংবাদকর্মীদের উপর হামলাও করেছিলো।

মাত্র ১৫ বছর আগেও যেসকল খোলা মাঠে গানবাজনা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো সেখানে এখন ইসলামী ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হয়। প্রায় প্রতিটি ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের ভাষ্য একই। বক্তারা বাংলাদেশে নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অবাদ চলাফেরা তথা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মুসলিমদের উসকানি দিচ্ছেন। ধর্মীয় বক্তাদের উসকানিতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও মুসলিম সমাজ প্রায়শই কর্মক্ষেত্রে এবং পথে ঘাটে নারীদের উপর আক্রমণ ও হেনস্থা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের উপর মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণের বহু ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রসাশন কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করছে না। ফলে আক্রমণের সংখ্যা দিনকে দিন আরো বাড়ছে।

বিগত ১৫ বছরে দেশে ২০ জনেরও বেশি ব্লগার ও মুন্তমনাদের মাদ্রাসা শিক্ষার্থী তথা মৌলবাদীরা হত্যা করেছে। হত্যার শিকারের তালিকায় রয়েছেন শিক্ষক, বিজ্ঞান লেখক ও প্রকাশকও। বাসা-অফিসে ঢুকে কিংবা প্রকাশ্যে জনসম্মুখে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও সরকার মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনসমর্থন অনেক জরুরি। মাদ্রসা শিক্ষার প্রসারের ফলে দেশে জঙ্গিবাদের পক্ষে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। যারা নাস্তিক কিংবা ভিন্ন মতের মানুষদের হত্যাকে সমর্থন দিচ্ছে।

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শুধু মাদ্রাসার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এখন তারা মূলধারার পাঠ্যপুস্তক থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মানবতা, নারীর অধিকার এবং যৌন শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলছে। সরকার মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে পাষ্ঠপুস্তক সংস্কার করেছে। ধারাবাহিক বিজয়ের ফলে মাদ্রাসার সাথে সম্পৃক্ত মৌলবাদী গোষ্ঠী আরো লাগামহীন হয়ে উঠছে।

মৌলবাদী গোষ্ঠীর সংখ্যা এবং সমর্থন এতোটাই বেড়েছে যে, কারা সরকার পরিচালনা করবে তার জন্য মৌলবাদীদের সমর্থনের প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে, সরকার মৌলবাদকে আরো উৎসাহিত করছে। সরকারের পক্ষ থেকে মৌলবাদী গোষ্ঠীর নেতাদের বিভিন্ন আলোচনা এবং অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে আনা হচ্ছে। এমনকী মৌলবাদী নেতাদের সরকার প্রধানের পাশের চেয়ারেও বসতে দেখা যাচ্ছে। ফলে মৌলবাদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রর্যায়ে পৌঁছার সবথেকে সহজ মাধ্যমে পরিনত হয়েছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যদি মৌলবাদীরা দখল করতে পারে দেশের সকল কৃষ্টি কালচার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। গান বাজনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হবে। খর্ব হবে নারীর অধিকার। নারী ও শিশু নির্যাতনের হার মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বাতিল হবে নারীদের শিক্ষাগ্রহণের অধিকার। কর্মসংস্থান থেকে নারীদের বিতাড়িত হতে হবে।

এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি ও অধিকারের আইনটিও বাতিল হবে। ভিন্ন ধর্মের মানুষদের হত্যা ও লুটপাট করা হবে। এবং ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়গুলোকে ধ্বংস করা হবে। মূলধারার শিক্ষা থেকে সরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসলামি শিক্ষা দিতে বাধ্য হবে। পুলিশে ক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করে ইসলামি পুলিশ দিয়ে আইন শৃঙ্গলা পরিচালনা করে হবে। দেশের সমস্ত ইতিহাস, স্তম্ভ এবং ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলা হবে। মানুষ হত্যা কোনো অপরাধ বলে আর বিবেচিত হবে না। অনেকগুলো জঙ্গি সংগঠন নতুন করে কার্যক্রম শুরু করবে। দেশটি একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে।

গণতান্ত্রিক সরকারগুলো বরাবরই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মৌলবাদের সাথে আঁতাত করে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও মৌলবাদকে তেমন গুরুত্বের সাথে আমলে নিচ্ছে না। মাদ্রাসাগুলো থেকে জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি সংবদ্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছে এটি যেনো কেউ দেখেও দেখছে না। সময় এতোটাই পেরিয়ে গেছে যে এখন আর তা লাগাম দেয়ার পর্যায়ে নেই। মৌলবাদের বোমা বাংলাদেশের মানচিত্রজুড়ে পাতা হয়ে গেছে এখন শুধু বিস্ফোরণের অপেক্ষা। মৌলবাদ যখন সংঘবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে, শত আঁতাত করেও আর রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো।

রিয়াজ সোহেল

সাংবাদিক

মাদ্রাসা
Blogs

মৌলবাদের উত্থান ঘটাতে পারে মাদ্রাসার ব্যাপক প্রসার

দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা। বিজ্ঞান, ইংরেজি ও বাংলা মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় হুড়হুড় করে বাড়ছে ধর্মভিত্তিক

Read More »